পেন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা ইলেকট্রনিক্সের জগতে একটি অভূতপূর্ব অগ্রগতি এনেছেন। তারা বিশ্বের প্রথম কার্যকরী কম্পিউটার তৈরি করেছেন, যা সম্পূর্ণভাবে দুই-মাত্রিক (2D) উপাদান দিয়ে নির্মিত এবং এর পুরুত্ব মাত্র একটি পরমাণুর সমান। এই উদ্ভাবন সিলিকন-নির্ভর ইলেকট্রনিক্সের দীর্ঘদিনের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করছে এবং ভবিষ্যতের জন্য অতি পাতলা, দ্রুত, শক্তি-সাশ্রয়ী এবং নমনীয় ডিভাইসের সম্ভাবনা উন্মোচন করছে। এই আবিষ্কার আধুনিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে একটি নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে, যা স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, পরিধানযোগ্য ডিভাইস এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ভবিষ্যৎকে পুনর্নির্মাণ করতে পারে।

2D computer only one atom thick

সিলিকন-ফ্রি কম্পিউটিং: কীভাবে সম্ভব হলো?

গত প্রায় ৮০ বছর ধরে সিলিকন আধুনিক কম্পিউটিংয়ের মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করে আসছে। সিলিকনের অর্ধপরিবাহী বৈশিষ্ট্য এটিকে ট্রানজিস্টর তৈরির জন্য আদর্শ করে তুলেছে, যা কম্পিউটার চিপের মূল উপাদান। কিন্তু প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে ডিভাইসগুলো ক্রমশ ছোট হচ্ছে, এবং এই ক্ষুদ্র স্কেলে সিলিকনের কর্মক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। বিশেষ করে, ন্যানোমিটার স্কেলে সিলিকনের বৈদ্যুতিক গুণাবলী অক্ষুণ্ণ রাখা কঠিন হয়ে পড়ে, যার ফলে শক্তি খরচ বেড়ে যায় এবং তাপ উৎপন্ন হয়।

এই সমস্যার সমাধানে পেন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা দুই-মাত্রিক (2D) উপাদানের দিকে মনোযোগ দিয়েছেন। এই উপাদানগুলো, যেমন মলিবডেনাম ডাইসালফাইড (MoS₂) এবং টাংস্টেন ডাইসেলেনাইড (WSe₂), মাত্র এক পরমাণু পুরু হলেও তাদের বৈদ্যুতিক বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ থাকে। এই বৈশিষ্ট্য তাদেরকে সিলিকনের তুলনায় অনেক বেশি কার্যকরী করে তোলে, বিশেষ করে অতি ক্ষুদ্র স্কেলে। এই 2D উপাদানগুলোর সরাসরি ব্যান্ডগ্যাপ (direct bandgap) তাদের ইলেকট্রন পরিবহনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত দক্ষ করে, যা দ্রুত এবং শক্তি-সাশ্রয়ী কম্পিউটিংয়ের জন্য আদর্শ।

প্রযুক্তিগত বিশদ

এই যুগান্তকারী কম্পিউটারটি নির্মাণে গবেষকরা CMOS (complementary metal-oxide-semiconductor) প্রযুক্তি ব্যবহার করেছেন, যা আধুনিক ইলেকট্রনিক্সের মূল ভিত্তি। CMOS প্রযুক্তি n-type এবং p-type ট্রানজিস্টরের সমন্বয়ে কাজ করে, যা কম শক্তি খরচে উচ্চ পারফরম্যান্স প্রদান করে। এই প্রকল্পে ব্যবহৃত প্রধান উপাদান এবং প্রযুক্তিগত বিশদ নিম্নরূপ:

  • ব্যবহৃত উপাদান:

    • n-type ট্রানজিস্টরের জন্য: মলিবডেনাম ডাইসালফাইড (MoS₂), যা উচ্চ ইলেকট্রন গতিশীলতার জন্য পরিচিত।
    • p-type ট্রানজিস্টরের জন্য: টাংস্টেন ডাইসেলেনাইড (WSe₂), যা উচ্চ হোল গতিশীলতা প্রদান করে।
    • এই দুটি উপাদান একত্রে CMOS সার্কিটের জন্য প্রয়োজনীয় পরিপূরক বৈশিষ্ট্য প্রদান করে।
  • নির্মাণ পদ্ধতি: গবেষকরা Metal-organic chemical vapor deposition (MOCVD) প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই এক-পরমাণু পুরু 2D উপাদানের পাত তৈরি করেছেন। MOCVD একটি অত্যাধুনিক কৌশল, যা উচ্চ-মানের, অভিন্ন এবং স্কেলযোগ্য উপাদান উৎপাদন সম্ভব করে।

  • ট্রানজিস্টরের সংখ্যা: এই প্রোটোটাইপ কম্পিউটারে ২,০০০-এর বেশি ট্রানজিস্টর ব্যবহার করে একটি "one instruction set computer" (OISC) তৈরি করা হয়েছে। এই কম্পিউটার সরল নির্দেশনা সেটের মাধ্যমে মৌলিক কম্পিউটিং কাজ সম্পাদন করতে সক্ষম।

  • পারফরম্যান্স: এই কম্পিউটারটি সর্বোচ্চ ২৫ কিলোহার্টজ (kHz) গতিতে কাজ করতে পারে। যদিও এই গতি আধুনিক সিলিকন-ভিত্তিক চিপের তুলনায় অনেক কম, তবে এটি 2D উপাদানের সম্ভাবনার একটি প্রাথমিক প্রমাণ হিসেবে যুগান্তকারী। আধুনিক সিলিকন চিপ গিগাহার্টজ (GHz) পরিসরে কাজ করে, তবে 2D উপাদানের ক্ষেত্রে এই প্রাথমিক সাফল্য ভবিষ্যতের উন্নতির জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি স্থাপন করেছে।

কেন 2D উপাদান?

2D উপাদানের ব্যবহার ইলেকট্রনিক্সের ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা প্রদান করে:

  1. অতি ক্ষুদ্র স্কেলে কর্মক্ষমতা অক্ষুণ্ণ: সিলিকন যখন ন্যানোমিটার স্কেলে কাজ করে, তখন এর বৈদ্যুতিক গুণাবলী যেমন ইলেকট্রন গতিশীলতা এবং ব্যান্ডগ্যাপ নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে, ডিভাইসগুলো অতিরিক্ত গরম হয় এবং শক্তি দক্ষতা কমে যায়। 2D উপাদান, যেমন MoS₂ এবং WSe₂, এক-পরমাণু পুরু হলেও তাদের বৈদ্যুতিক বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ থাকে, যা অতি ক্ষুদ্র ডিভাইসের জন্য আদর্শ।

  2. শক্তি সাশ্রয়ী: CMOS আর্কিটেকচারে n-type এবং p-type ট্রানজিস্টরের সমন্বয় কম শক্তি খরচে উচ্চ দক্ষতার অপারেশন সম্ভব করে। 2D উপাদানের উচ্চ গতিশীলতা এবং সরাসরি ব্যান্ডগ্যাপ এই শক্তি দক্ষতাকে আরও বাড়িয়ে দেয়।

  3. নমনীয়তা এবং স্কেলযোগ্যতা: 2D উপাদানগুলো অত্যন্ত পাতলা এবং নমনীয়, যা তাদেরকে মোড়ানো বা বাঁকানো যায় এমন ডিভাইস তৈরির জন্য উপযুক্ত করে। এছাড়া, MOCVD-এর মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই উপাদানগুলো বড় আকারে উৎপাদন করা সম্ভব।

  4. পরিবেশবান্ধব সম্ভাবনা: কম শক্তি খরচ এবং দীর্ঘস্থায়ী বৈশিষ্ট্যের কারণে 2D উপাদান-নির্ভর ডিভাইসগুলো পরিবেশের উপর কম প্রভাব ফেলে, যা টেকসই প্রযুক্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

ভবিষ্যতের অ্যাপ্লিকেশন

এই 2D উপাদান-নির্ভর কম্পিউটার প্রযুক্তি ইলেকট্রনিক্সের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে। কিছু সম্ভাব্য অ্যাপ্লিকেশন হলো:

  1. ফ্লেক্সিবল ইলেকট্রনিক্স: 2D উপাদানের পাতলা এবং নমনীয় প্রকৃতির কারণে মোড়ানো যায় এমন ডিসপ্লে, পরিধানযোগ্য ডিভাইস এবং স্মার্ট টেক্সটাইল তৈরি সম্ভব হবে। উদাহরণস্বরূপ, ভাঁজ করা যায় এমন স্মার্টফোন স্ক্রিন বা কাপড়ে এম্বেড করা সেন্সর।

  2. হাই-স্পিড কম্পিউটিং: 2D উপাদানের সরাসরি ব্যান্ডগ্যাপ এবং উচ্চ ইলেকট্রন গতিশীলতা দ্রুত এবং দক্ষ কম্পিউটিং সম্ভব করে। ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তি উন্নত করা গেলে, এটি আধুনিক সিলিকন চিপের তুলনায় আরও দ্রুত কম্পিউটার তৈরি করতে পারে।

  3. এনার্জি হার্ভেস্টিং ও সেন্সিং: 2D উপাদান পরিবেশগত সেন্সর, স্মার্ট স্কিন, সোলার সেল এবং অন্যান্য শক্তি সংগ্রহের ডিভাইসে ব্যবহার করা যেতে পারে। এগুলো বিশেষ করে চিকিৎসা, পরিবেশ নিরীক্ষণ এবং স্মার্ট সিটিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

  4. পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি: কম শক্তি খরচ এবং দীর্ঘস্থায়ী বৈশিষ্ট্যের কারণে এই প্রযুক্তি পরিবেশবান্ধব ডিভাইস তৈরির পথ প্রশস্ত করবে। এটি কার্বন নির্গমন হ্রাস এবং টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে অবদান রাখতে পারে।

গবেষকদের মন্তব্য ও ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা

গবেষক দলের প্রধান অধ্যাপক সপ্তর্ষি দাস বলেন, “সিলিকন দীর্ঘদিন ধরে ইলেকট্রনিক্সের জগতে রাজত্ব করে এসেছে, কিন্তু ডিভাইসের আকার কমে যাওয়ার সাথে সাথে এর কর্মক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। 2D উপাদানগুলো মাত্র এক পরমাণু পুরু হলেও তাদের বৈদ্যুতিক বৈশিষ্ট্য অত্যন্ত শক্তিশালী, যা ভবিষ্যতের ইলেকট্রনিক্সের জন্য একটি নতুন পথ দেখাচ্ছে।”

গবেষকরা জানিয়েছেন, এই প্রযুক্তি এখনো তার প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। তবে আরও গবেষণা এবং উন্নয়নের মাধ্যমে এটি সিলিকন-ভিত্তিক প্রযুক্তিকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। তাদের লক্ষ্য হলো:

  • ট্রানজিস্টরের ঘনত্ব বাড়ানো এবং কম্পিউটারের গতি উন্নত করা।
  • আরও জটিল সার্কিট ডিজাইন করা, যা আধুনিক অ্যাপ্লিকেশনের চাহিদা পূরণ করতে পারে।
  • বাণিজ্যিক উৎপাদনের জন্য স্কেলযোগ্য এবং সাশ্রয়ী উৎপাদন পদ্ধতি উন্নয়ন।

উপসংহার

পেন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গবেষণা ইলেকট্রনিক্সের ক্ষেত্রে একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে। এক-পরমাণু পুরু 2D উপাদান দিয়ে তৈরি এই কম্পিউটার প্রযুক্তি ভবিষ্যতে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে—স্মার্টফোন থেকে শুরু করে চিকিৎসা ডিভাইস, পরিবেশ নিরীক্ষণ এবং শক্তি ব্যবস্থাপনায়—আমূল পরিবর্তন আনতে পারে। সিলিকনের বিকল্প হিসেবে 2D উপাদানের উত্থান আমাদের সামনে একটি নতুন, দক্ষ এবং টেকসই প্রযুক্তির সম্ভাবনা উন্মোচন করেছে। এই আবিষ্কার কেবল প্রযুক্তির অগ্রগতিই নয়, বরং পরিবেশবান্ধব এবং সাশ্রয়ী ভবিষ্যতের জন্যও একটি উজ্জ্বল সম্ভাবনা তৈরি করছে।

Leave a Comment