প্লুটো—সূর্য থেকে বহু দূরের এক বরফাচ্ছন্ন বামন গ্রহ—২০১৫ সালে NASA-র New Horizons মিশন ও সাম্প্রতিক James Webb Space Telescope (JWST)-এর পর্যবেক্ষণে নতুন করে বৈজ্ঞানিক কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে। বিশেষত, প্লুটোর আকাশে দেখা নীলচে বহুস্তরীয় কুয়াশা নিয়ে বিজ্ঞানীদের আগ্রহের শেষ নেই। এই কুয়াশা শুধু দৃষ্টিনন্দন নয়, বরং প্লুটোর পরিবেশ ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে এটি একেবারে অনন্য ভূমিকা রাখে।

Pluto’s blue haze


প্লুটোর কুয়াশার বৈজ্ঞানিক গঠন

সূর্যালোক ও রাসায়নিক বিক্রিয়া

  • প্লুটোর বায়ুমণ্ডলে প্রধানত নাইট্রোজেন (N₂), মিথেন (CH₄) ও কার্বন মনোক্সাইড (CO) রয়েছে। সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি (UV) এই গ্যাসগুলোর ওপর পড়লে ফোটোকেমিক্যাল বিক্রিয়া শুরু হয়।

  • এই বিক্রিয়ায় মিথেন ও নাইট্রোজেন ভেঙে যায় এবং নানা ধরনের জটিল অর্গানিক অণু (যেমন অ্যাসিটিলিন, ইথিলিন, হাইড্রোজেন সায়ানাইড) তৈরি হয়।

  • এসব অণু একত্রিত হয়ে ক্ষুদ্র কণা (হ্যাজ পার্টিকল, সাধারণত ১০-১০০ ন্যানোমিটার) গঠন করে, যা প্লুটোর আকাশে ভেসে বেড়ায়।

নীলচে রঙের উৎস

  • এই কণাগুলো সূর্যালোক ছড়িয়ে দেয় (Rayleigh Scattering), যার ফলে প্লুটোর আকাশে নীলচে আভা দেখা যায়—অনেকটা পৃথিবীর আকাশের মতো, তবে এখানে কণার আকার বড় এবং গঠন ভিন্ন।

  • গবেষণায় দেখা গেছে, এই কণার অনেকগুলোতে বরফের কণার ভেতরে বিষাক্ত হাইড্রোজেন সায়ানাইড জমা থাকে, যা প্লুটোর কুয়াশাকে আরও রহস্যময় করে তোলে।

বহুস্তরীয় গঠন

  • New Horizons-এর ডেটা অনুযায়ী, প্লুটোর কুয়াশা প্রায় ৩০০ কিলোমিটার (১৮৫ মাইল) উচ্চতায় বিস্তৃত এবং এতে ২০টিরও বেশি পৃথক স্তর রয়েছে।

  • এই স্তরগুলো প্লুটোর ভূ-প্রকৃতি (পাহাড়, উপত্যকা) ও বাতাসের ঢেউয়ের কারণে তৈরি হয়, যা সূর্যালোকের ছায়া ও প্রতিফলনের মাধ্যমে স্পষ্ট দেখা যায়।


কুয়াশার ভূমিকা: প্লুটো কেন এত ঠান্ডা?

Xi Zhang-এর ‘ক্রেজি আইডিয়া’ ও বৈজ্ঞানিক নিশ্চিতকরণ

  • ২০১৭ সালে অধ্যাপক Xi Zhang ধারণা দেন, প্লুটোর কুয়াশা কণা সূর্যালোক শোষণ করে এবং ইনফ্রারেড বিকিরণ হিসেবে তা মহাকাশে পাঠিয়ে দেয়, ফলে প্লুটোর তাপমাত্রা গড়পড়তা হিসেবের চেয়ে প্রায় ৩০°C কম থাকে।

  • সাধারণত, কুয়াশা বায়ুমণ্ডলকে উষ্ণ করে, কিন্তু প্লুটোতে উল্টো ঘটনা ঘটে—এটি ‘কুলিং হ্যাজ’ হিসেবে কাজ করে।

  • James Webb Space Telescope-এর MIRI ইন্সট্রুমেন্টের মাধ্যমে ২০২২-২৩ সালে সংগৃহীত ডেটা দেখিয়েছে, প্লুটোর কুয়াশা মধ্য-ইনফ্রারেড তরঙ্গে শক্তিশালী বিকিরণ ছাড়ে, যা Zhang-এর পূর্বাভাসের সঙ্গে হুবহু মিলে গেছে।

কণা ও পৃষ্ঠের সম্পর্ক

  • কুয়াশার কণা ধীরে ধীরে প্লুটোর পৃষ্ঠে পড়ে, যেখানে তারা জমে গিয়ে লালচে ও বাদামি রঙের জৈব পদার্থ তৈরি করে—এটি প্লুটোর পৃষ্ঠের বৈচিত্র্য ও রঙের উৎস5

  • এই কণা পৃষ্ঠের কাছাকাছি এসে আরও বড় হয় এবং দ্রুত পড়ে যায়, ফলে পৃষ্ঠে নতুন স্তর তৈরি হয়।


প্লুটোর কুয়াশা: সৌন্দর্য ও বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব

দৃষ্টিনন্দন ও বিষাক্ত

  • প্লুটোর নীলচে কুয়াশা দেখতে অপার্থিব সুন্দর হলেও, এর গঠন অত্যন্ত বিষাক্ত—হাইড্রোজেন সায়ানাইড ও অন্যান্য জটিল অর্গানিক অণু দিয়ে তৈরি।

  • এই কুয়াশা পৃথিবীর মতো জীবনের জন্য উপযোগী নয়, বরং একেবারে বিপরীত—এটি প্রাণের জন্য মারাত্মক।

সৌরজগত ও বাইরের গ্রহে প্রভাব

  • প্লুটোর কুয়াশা নিয়ে গবেষণা শুধু এই গ্রহেই সীমাবদ্ধ নয়; বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, একই ধরনের কুয়াশা নেপচুনের উপগ্রহ ট্রাইটন, শনি গ্রহের উপগ্রহ টাইটান এবং এমনকি এক্সোপ্ল্যানেটেও থাকতে পারে।

  • এই গবেষণা পৃথিবীর প্রাচীন বায়ুমণ্ডল ও জলবায়ু সম্পর্কেও নতুন ধারণা দিচ্ছে।

সারাংশ

প্লুটোর নীলচে বহুস্তরীয় কুয়াশা শুধু এক অপার্থিব সৌন্দর্য নয়—এটি প্লুটোর তাপমাত্রা, পৃষ্ঠের রঙ ও বৈচিত্র্য, এমনকি সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহ ও উপগ্রহের পরিবেশ বোঝার জন্য এক নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে। James Webb Space Telescope-এর আবিষ্কার প্রমাণ করেছে, বিজ্ঞানী Xi Zhang-এর তত্ত্ব সত্যি—কুয়াশার কণা প্লুটোকে আরও ঠান্ডা রাখে এবং এটি সৌরজগতের একমাত্র ‘কুলিং হ্যাজ’ গ্রহ।

তথ্যসূত্র:
6 Science Times
4 Lowell Observatory
5 Tachyon Beam
1 Live Science
2 Knowridge
3 Daily Galaxy

Leave a Comment