দক্ষিণ মেরুর জনমানবহীন, বরফশীতল প্রান্তরের হাজার হাজার ফুট উপরে একটি বিশাল হিলিয়াম বেলুনে ভেসে বেড়াচ্ছে এক অত্যাধুনিক গবেষণাগার। এর নাম অ্যান্টার্কটিক ইমপালসিভ ট্রান্সিয়েন্ট অ্যান্টেনা (Antarctic Impulsive Transient Antenna), বা সংক্ষেপে ANITA। এর মূল কাজ মহাকাশ থেকে ছুটে আসা উচ্চ-শক্তিসম্পন্ন কণা বা কসমিক রশ্মি শনাক্ত করা। কিন্তু সম্প্রতি এই যন্ত্রটি এমন কিছু রহস্যময় সংকেত সনাক্ত করেছে, যা কোনোভাবেই মহাকাশ থেকে আসছে না, বরং অ্যান্টার্কটিকার হাজার হাজার ফুট বরফ এবং তার নিচের কঠিন মাটি ভেদ করে উপরের দিকে উঠে আসছে। এই অদ্ভুত সংকেতগুলো বর্তমান পদার্থবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত নিয়মকে এক বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে এবং বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে তৈরি করেছে তীব্র কৌতূহল।



অ্যানিটা কী এবং এটি কীভাবে কাজ করে?

ANITA মূলত একটি রেডিও টেলিস্কোপ, যা মহাবিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং রহস্যময় ঘটনাগুলো থেকে সৃষ্ট নিউট্রিনো কণা শনাক্ত করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। নিউট্রিনোগুলোকে "ভুতুড়ে কণা" বলা হয়, কারণ এরা প্রায় সবকিছুর মধ্য দিয়েই কোনো বাধা ছাড়াই চলাচল করতে পারে।

যখন একটি অতি-উচ্চ শক্তির নিউট্রিনো অ্যান্টার্কটিকার বরফের স্তরে আঘাত করে, তখন এটি বরফের পরমাণুর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এই সংঘর্ষের ফলে একটি ক্যাসকেড বা  ঝরনা (cascade of charged particles) তৈরি হয়, যা আসকারিয়ান এফেক্ট (Askaryan effect) নামক একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে तीव्र রেডিও তরঙ্গের জন্ম দেয়। ANITA-র অ্যান্টেনাগুলো এই ক্ষীণ রেডিও সংকেত ধরার জন্যই বিশেষভাবে তৈরি। অ্যান্টার্কটিকার বরফ এ ধরনের পরীক্ষার জন্য আদর্শ, কারণ এটি রেডিও তরঙ্গের জন্য অত্যন্ত স্বচ্ছ এবং এখানে মানুষের তৈরি রেডিও কোলাহল প্রায় নেই।

সাধারণত, ANITA দুই ধরনের সংকেত পায়:

১. সরাসরি আকাশ থেকে আসা কসমিক রশ্মির সংকেত।

২. আকাশ থেকে আসা রশ্মি যা বরফের পৃষ্ঠে প্রতিফলিত হয়ে অ্যান্টেনার দিকে ফিরে আসে।

কিন্তু রহস্যের শুরু হয় তখন, যখন ANITA এমন কিছু সংকেত সনাক্ত করে যা বরফের গভীর থেকে, প্রায় উল্লম্বভাবে উপরের দিকে উঠে আসছে।

রহস্যময় সংকেত: যা সাধারণ নয়

২০১৬ এবং ২০১৮ সালে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে বিজ্ঞানীরা দুটি এমন ঘটনার কথা উল্লেখ করেন যা পদার্থবিজ্ঞানের বর্তমান মডেল দিয়ে ব্যাখ্যা করা প্রায় অসম্ভব। এই সংকেতগুলো এমন একটি কোণ থেকে আসছিল যা থেকে বোঝা যায়, এগুলো পৃথিবীর অপর প্রান্ত থেকে যাত্রা শুরু করে গ্রহের কেন্দ্র ভেদ করে অ্যান্টার্কটিকার বরফ ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে।

এখানেই মূল সমস্যা। পদার্থবিজ্ঞানের স্ট্যান্ডার্ড মডেল অনুসারে, উচ্চ-শক্তির নিউট্রিনোগুলো পৃথিবীর এত গভীরে প্রবেশ করার সময় পদার্থের সাথে প্রতিক্রিয়া করার সম্ভাবনা অনেক বেশি। অর্থাৎ, হাজার হাজার কিলোমিটার কঠিন মাটি ও পাথর ভেদ করে এদের অক্ষত অবস্থায় বেরিয়ে আসার কথা নয়। পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞানী ডерек ফক্সের মতে, "একটি উচ্চ-শক্তির নিউট্রিনোর পৃথিবীর মধ্য দিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।" তাহলে এই সংকেতগুলো কীসের?

সম্ভাব্য ব্যাখ্যা ও তত্ত্ব

এই রহস্যময় সংকেতের উৎস নিয়ে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন তত্ত্ব দিয়েছেন, যার প্রতিটিই অত্যন্ত চমকপ্রদ।

১. নতুন ধরনের কণা: স্টেরাইল নিউট্রিনো বা সুপারসিমেট্রিক পার্টিকল?

সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ ধারণাটি হলো, আমরা হয়তো একটি সম্পূর্ণ নতুন ধরনের কণার সন্ধান পেয়েছি যা স্ট্যান্ডার্ড মডেলের বাইরে। একটি সম্ভাব্য প্রার্থী হলো "স্টেরাইল নিউট্রিনো" (sterile neutrino), যা সাধারণ নিউট্রিনোর চেয়েও পদার্থের সাথে কম প্রতিক্রিয়া করে এবং সহজেই পৃথিবীর মধ্য দিয়ে যেতে পারে।

আরেকটি ধারণা সুপারসিমেট্রি (Supersymmetry বা SUSY) তত্ত্ব থেকে আসে। এই তত্ত্ব অনুসারে, আমাদের পরিচিত প্রতিটি কণার একটি ভারী "সুপারপার্টনার" কণা রয়েছে। হতে পারে এই সংকেতগুলো "স্টাউ" (stau) নামক একটি সুপারসিমেট্রিক কণার ক্ষয় থেকে তৈরি হচ্ছে, যা পৃথিবীর মধ্য দিয়ে এসে অ্যান্টার্কটিকার কাছে এসে আমাদের পরিচিত টাউ নিউট্রিনোতে (tau neutrino) পরিণত হচ্ছে এবং সেই সংকেত ANITA ধরছে।

২. বরফের স্তরের ভুল ব্যাখ্যা?

কিছু বিজ্ঞানী আরও বাস্তবসম্মত একটি ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তাদের মতে, হতে পারে অ্যান্টার্কটিকার বরফের অভ্যন্তরীণ গঠন আমাদের ধারণার চেয়েও জটিল। বরফের নিচে থাকা কোনো বিশেষ স্তর বা "ফার্ন" (firn - জমাট বাঁধা তুষার) আকাশ থেকে আসা সাধারণ কসমিক রশ্মিকে এমনভাবে প্রতিফলিত করছে, যা দেখে মনে হচ্ছে সংকেতটি নিচ থেকে আসছে। যদিও এই তত্ত্বটি এখনো প্রমাণিত হয়নি, তবে এটি নতুন পদার্থবিজ্ঞানের আশ্রয় না নিয়েই একটি সম্ভাব্য সমাধান দিতে পারে।

৩. অন্যান্য পর্যবেক্ষণ ও ভবিষ্যৎ গবেষণা

এই রহস্য আরও ঘনীভূত হয়েছে যখন অ্যান্টার্কটিকাতেই অবস্থিত আরেকটি বিশাল ডিটেক্টর, আইসকিউব নিউট্রিনো অবজারভেটরি (IceCube Neutrino Observatory), ANITA-র মতো কোনো অস্বাভাবিক সংকেত খুঁজে পায়নি। দুটি ভিন্ন ধরনের ডিটেক্টর থেকে ভিন্ন ফলাফল আসায় বিজ্ঞানীরা আরও দ্বিধায় পড়েছেন।

এই রহস্য সমাধানের জন্য নাসা (NASA) এবং অন্যান্য সংস্থাগুলো আরও উন্নত প্রযুক্তির ডিটেক্টর তৈরির পরিকল্পনা করছে। এর মধ্যে PUEO (Payload for Ultrahigh Energy Observations) এবং RNO-G (Radio Neutrino Observatory in Greenland) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই নতুন প্রজন্মের পরীক্ষাগুলো আরও সংবেদনশীল হবে এবং হাজার হাজার সংকেত বিশ্লেষণ করে এই ঘটনার একটি সঠিক চিত্র তুলে ধরতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে।

উপসংহার

ANITA-র এই অদ্ভুত সংকেতগুলো আমাদের মহাবিশ্ব সম্পর্কে জ্ঞানের সীমানাকে নাড়িয়ে দিয়েছে। এটি কি পদার্থবিজ্ঞানে এক নতুন দিগন্তের সূচনা, যা আমাদের স্ট্যান্ডার্ড মডেলের পুনর্গঠন করতে বাধ্য করবে? নাকি এটি প্রকৃতি এবং আমাদের পরিমাপ পদ্ধতির এক জটিল ধাঁধা, যার সমাধান লুকিয়ে আছে অ্যান্টার্কটিকার বরফের গভীরে?

উত্তর যাই হোক না কেন, এই অনুসন্ধান বিজ্ঞানীদের মধ্যে নতুন করে প্রাণের সঞ্চার করেছে। প্রতিটি অমীমাংসিত রহস্যই নতুন আবিষ্কারের দরজা খুলে দেয়। ANITA-র এই ভুতুড়ে সংকেত সেই দরজাই খুলে দিয়েছে, যার ওপারে হয়তো লুকিয়ে আছে মহাবিশ্বের এক অজানা অধ্যায়।

Leave a Comment